সমস্ত লেখাগুলি

পুষ্প আপনার জন্য ফোটে না -
কৃষ্ণপদ ভৌমিক
Nov. 23, 2024 | জীবনী | views:811 | likes:0 | share: 0 | comments:0

প্রচণ্ড দারিদ্রতাকে সঙ্গে নিয়ে প্রথম প্রজন্মের ছাত্র হিসেবে কলকাতায় পড়তে গিয়ে প্রচণ্ড সমস্যার মুখোমুখি হই। ইংরেজি অনার্স পড়বার আগে ভেবে রোমাঞ্চিত হতাম যে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের খুঁটিনাটি কতো কিছু জানতে পারব। ইংরেজিটা একেবারে মাতৃভাষার মতো হয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবে দেখলাম, ইংরেজি সাহিত্যের প্রতি যাবতীয় আকর্ষণ শেষ করে দেওয়ার পক্ষে ইংরেজি অনার্স কোর্সটিই যথেষ্ট। ইংরেজির তেমন কিছু জানতে হবে না,শুধু নোটস কিনে মুখস্ত করতে হবে। সেই নোটসের মধ্যে নানা জনের লেখা থেকে টুকে বড় বড় কোটেশন দিয়ে নানা রকমের বিশেষণ ব্যাবহার করে বোঝানো আছে লেখক কিংবা কবি কতো ভালো লিখেছেন, কিংবা টাইটেল টা খুব সুন্দর হয়েছে ইত্যাদি! একই কথার চর্বিতচর্বণ করে, একটু এদিক ওদিক করে বিচ্ছিরি হাতের লেখায় সব বড় বড় এক গাদা নোটস। আমার নিজের থাকা খাওয়ার জন্য টাকা নাই। তার ওপর নোটস জোগাড় করতে অনেক টাকা দিয়ে টিউশন পড়তে হবে। অসম্ভব ব্যাপার। আমি বরাবরের অন্তর্মুখী। মুখ ফুটে কিছু বলতে পারতাম না। তাই ক্লাসে যে স্যারের পড়া খুব ভালো লাগে, সেই স্যারকেই সমস্যার কথা জানিয়ে কলেজের ঠিকানায় একখানা চিঠি লিখে পাঠিয়ে দিলাম। কিছু দিন পরে দেখি আমার গ্রামের বাড়িতে একটা চিঠি আসে। আমাদের প্রিয় অধ্যাপক শ্রী রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের লেখা চিঠি। চিঠিতে তিনি আমাকে পূজার ছুটির পর কলেজ খুললে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বলেন। চিঠি পেয়ে এক অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছিল সেদিন। 



দেখা করে বললাম, স্যার গ্রামে থাকার সময় নিজে নিজে পড়াশুনা করেছি, এইভাবে  টিউশন পড়তাম না। বইপত্র সব বাঙলায় হওয়ায় কোনও সমস্যা হয় নি এতোদিন। কিন্তু এখন খুব সমস্যা হচ্ছে। সবচেয়ে সমস্যা হলো আমার মুখস্ত মনে থাকে না। আর না বুঝে মুখস্ত করতেও পারি না। আমাদের প্রিয় RKB Sir বললেন Self-Study হলো শিক্ষার সবচেয়ে ভালো উপায়। তিনি আমার হতাশ মনে সাহস দিয়ে বললেন টেক্সট গুলো আগে ভালো করে পড়। তারপর নিজে থেকে এক একটা প্রশ্নের উত্তর লিখে ফেল। তারপর যা লিখবি আমাকে দিয়ে চেক করিয়ে নিবি। বাড়ির ঠিকানাটাও দিলেন। সেই শুরু। যখন বললাম স্যার কোটেশন কি দিতেই হবে? কোটেশন হুবহু মনে থাকে না যে। তিনি বললেন কোথায় কে কী বলেছেন সেটা মুখস্ত করতে পারলি কিনা পরীক্ষায় তা জানতে চাওয়া হয় না। ইউনিভার্সিটি জানতে চায় তুই নিজে কী বুঝেছিস। আমার সুবিধার জন্য তিনি অনেক বইও দিতেন। 

এরপর নিয়মিত যাতায়াত, বইপত্র, সমাজ ও দর্শন নিয়ে আলোচনা করতাম। পরবর্তীতে, আমার এম. এ. পড়ার সময়ও যাবতীয়  জিজ্ঞাসার সমাধান খুঁজতে আমি এই স্যারের কাছেই যেতাম।

 আমি বুঝতে পারি RKB এমন একজন প্রকৃত শিক্ষক যাঁর কাছে সিলেবাস নির্ভর পড়াশুনার বাইরে,জ্ঞান সমুদ্রের অগাধ মণিমুক্তোর সন্ধান আছে, যেগুলি আমার খুব প্রয়োজন। 

তিনি বস্তুবাদী দার্শনিক, চার্বাকের ওপর তাঁর অনেক গবেষণা। তিনি যুক্তিবাদী ও নাস্তিক মানুষ।

 এই জায়গায় আমার চিন্তা ভাবনার সঙ্গে বিরাট মিল খুঁজে পাই।
















পর্ব - ২

অধ্যাপক রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই জ্ঞানের উপাসক। তিনি সংসার করেননি, শ্যামবাজারের মোহনলাল স্ট্রিটের পুরনো লাল বাড়িটির টপ ফ্লোরটিতে ছিল তাঁর অন্য রকমের এক সংসার। দুটো ঘর ভর্তি নানা রকমের বই আর বই, সঙ্গে তাঁর নিজস্ব গবেষণালব্ধ বিভিন্ন বই ও লেখা পত্র এবং একটা কম্পিউটার। যখনই যেতাম দেখতাম কোনও না কোনও প্রকাশক, গবেষক, বিখ্যাত ম্যাগাজিন এবং লিট্ল ম্যাগাজিনের জন্য লেখা প্রত্যাশী লোকজন এসেছেন কথা বলতে। অত্যন্ত সময়ানুবর্তী মানুষটির খাওয়া, লাইব্রেরিতে যাওয়া, পড়াশুনা, লেখালেখি সবই নির্দিষ্ট রুটিন অনুযায়ী হতো। প্রখর স্মৃতি শক্তির অধিকারী ছিলেন। 

তাঁর গবেষণালব্ধ বইগুলো পড়লে বোঝা যায়, যে অন্য কোনও গবেষকের তথ্যকে যাচাই না করে তিনি গ্রহণ করতেন না বা কোনও সিদ্ধান্তে আসতেন না। বিদ্যাসাগরের ওপর তাঁর "বিদ্যাসাগর: নানা প্রসঙ্গ" বইটি অতুলনীয়, যেখানে বিদ্যাসাগরকে নিয়ে তোলা বিভিন্ন প্রশ্নের তথ্য প্রমাণ সহ আলোচনা আছে। এছাড়াও তিনি Aristotle এর Poetics, এবং Sophocles এর King Oedipus র ওপরও গবেষণা করেছেন। তিনি তাঁর লেখা গুলি প্রকাশ করেছেন এক অতি সুন্দর, সহজবোধ্য নিজস্ব গদ্য রীতিতে। 

রামকৃষ্ণ বাবু ছিলেন দলীয় নিয়ন্ত্রণ মুক্ত মার্ক্সবাদ চর্চার একজন কাণ্ডারী।

 ইউরোপীয় রেনেসাঁর ফলে জ্ঞান বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বস্তুবাদী দর্শনের যে  বিকাশ লাভ হয়েছিল, তারই গর্ভে জন্ম নিয়েছিল মার্ক্সবাদ। এখন মার্ক্সবাদের আলোকে সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়তে হলে দরকার মানুষের মধ্যে চেতনার গুণগত মানোন্নয়ন, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার ও অপসংস্কৃতি থেকে মুক্তি, জ্ঞান বিজ্ঞান তথা বস্তুবাদী দর্শনের প্রসার। অধ্যাপক ভট্টাচার্য ঠিক এই জায়গাটাতে হাত দিয়েছিলেন। বিখ্যাত সব ম্যাগাজিনের পাশাপাশি অসংখ্য লিটল ম্যাগাজিন, পাক্ষীক, ছোট ছোট বই, বিভিন্ন গণসংগঠন, সমাজ সচেতন সহকর্মী, দেশে বিদেশে ছড়িয়ে থাকা অধ্যাপক, শিক্ষক, পাঠক, সমাজকর্মী, মানবাধিকার আন্দোলনের সংগঠক ও ছাত্র ছাত্রীরা মিলে গড়ে উঠেছিল এক বিশাল জনপরিসর, যার মধ্যমণি আমাদের 

RKB যাঁর লক্ষ্য ছিল এদের মাধ্যমে ভবিষ্যতে সমাজতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের উদ্দেশ্যে জনমানসে বিজ্ঞান ভিত্তিক ও বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার।

এজন্য তিনি অত্যন্ত সচেতনভাবে কর্পোরেট মিডিয়ার আকর্ষণীয় প্রস্তাব ও আত্মপ্রচারকে দুরে ঠেলে দিয়েছেন। কিছুদিন আগে আমি একবার প্রস্তাব দিয়েছিলাম যে, স্যার, আমরা আপনাকে নিয়ে একটা লিটল ম্যাগাজিনের সংখ্যা প্রকাশ করতে চাই। এ জন্য একাধিক সম্পাদক মুখিয়ে আছেন। তিনি বললেন কখ্খনো না, আমি বেঁচে থাকতে তো হবেই না, আমি মারা যাওয়ার পরও যেন না হয়। তিনি চান ব্যাক্তির প্রচার নয়, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের প্রচার হোক। বর্তমানে আত্মপ্রচার সর্বস্ব বঙ্গীয় বুদ্ধিজীবীরা যেখানে একদিকে জনগণের জন্য 'দুঃখে' কুম্ভীরাশ্রু ফেলছে, আর অন্যদিকে ক্ষমতার পিঠ চাপড়ে নিজেরটা গুছিয়ে নেওয়ার জন্য হামলে পড়ছে অর্থাৎ ঠকবাজীতে অকুতোভয়, সেখানে নীরবে নিভৃতে থাকা RKB র মতো মানুষ  আমাদের কাছে যেন বটবৃক্ষের নীচে এক শান্ত ছায়াতল।।


পর্ব-৩


স্যারের রসবোধটিও ছিল অসাধারণ। একবার স্যারের টেবিলে গিয়ে ভগবান ভীত সংবাদপত্রটি দেখে বলি স্যার নাস্তিক মানুষের কাছে এই কাগজ কেন? স্যার হেসে বলেন, এই কাগজটা দেখে তুই আমাকে ছোটলোক ভেবে বসলি! একবার বাংলাদেশের এক গবেষক কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে এসেছিলেন। RKB র সঙ্গে কিছু আলোচনা করতে আসেন। কিছুক্ষণ পর তার কথাবার্তা মুজিবর রহমানের দিকে ঘুরে যায়। তিনি নানাভাবে বোঝাতে থাকেন মুজিবর রহমান এক সাংঘাতিক খারাপ লোক, আর তার দলটিও ততোধিক খারাপ। এই বোঝানোর প্রক্রিয়ায় মূল প্রসঙ্গ ছেড়ে অনেকটা সময় নষ্ট করেন। তিনি চলে গেলে স্যার আমাদের বলেন মুজিব তো আরও একবার নিহত হলেনই, সঙ্গে আমার আজকের বিকেলটাও মারা পড়ল। 

প্রতিটি ছাত্রকে তিনি এক অদ্ভুত অনুপ্রেরণা দিতে পারতেন। মাঝে মাঝে হতাশ হয়ে বলতাম স্যার প্রগতিশীলতার পক্ষে সমাজের কোনও পরিবর্তন তো দেখতে পাচ্ছি না। এতো শিক্ষক, অধ্যাপক, বিজ্ঞানী, চিকিৎসক ইত্যাদি যাইহোক না কেন, তাদের বেশিরভাগই তো সাংঘাতিক কুসংস্কারাচ্ছন্ন, ধর্মান্ধ, গতানুগতিক এবং সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন। তিনি বলতেন সভ্যতার ইতিহাস হাজার হাজার বছরের চলমান প্রক্রিয়া। আর একটা মানুষের জীবন ষাট সত্তর বছরের জীবন। এই এত অল্প সময়ে সবকিছু ভালো দেখে যেতে পারব ভাবলে চলে না। একটু একটু করে পরিবর্তন অবশ্যই হয়। আমাদের এই ক্ষণস্থায়ী জীবনে  এই প্রগতিশীলতার ধারাটিকে যতটা পারি রক্ষা ও বেগবান করার চেষ্টা করে যেতে হবে। তিনি ক্লান্তিহীন উৎসাহদাতা। 

নাস্তিকরাই ধর্মটাকে ভালো বোঝে, রবিঠাকুরের এই কথাটা RKB Sir এর কাছে এলে বেশ মালুম হয়। ধর্ম তত্ত্ব নিয়ে তাঁর ব্যপক পড়াশুনা ও গবেষণা।

 তাই ঈশ্বর বা ঠাকুর দেবতা নিয়ে বিন্দুমাত্র মোহ নাই তাঁর। তিনি বস্তুবাদের পক্ষে যেখানে যা উপাদান পেয়েছেন, তাই সংগ্রহ করেছেন। "উপনিষদে বস্তুবাদ" তাঁর একটি অনবদ্য প্রবন্ধ। তাঁর জীবনই আমাদের কাছে একটা শিক্ষণীয় বিষয়। তাঁর কাছে গেলে তিনি কখনও তাঁর একটা বই কিনতে বলেন নি। ফুলের প্রতি সবাই যেমন আকৃষ্ট হয়, আমরাও আকৃষ্ট হয়ে যেতাম তাঁর কাছে। 

যখনই যেতাম তিনি আমার বাড়ির খবর, আত্মীয় স্বজনদের খবর, গ্রামের খবর, রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশের খবরাখবর নিতেন। কিছুদিন আগে বাড়িতে গিয়ে ছিলাম, গত ২৬শে সেপ্টেম্বর বিদ্যাসাগরের  জন্ম দিনে শেষবারের মতো হাসপাতালে গিয়ে Sir কে দেখলাম,  তিনি কিছু বললেন, কিন্তু কী বললেন কিছু বুঝতে পারলাম না। আর কোনো দিন তিনি কথা বলবেন না, কিন্তু তাঁর শিক্ষা, তাঁর বইপত্র চিরকাল আমাদের সঙ্গে কথা বলবেন। তিনি সর্বত্যাগী, মানবতাবাদী। গত ২ রা অক্টোবর, ২০২২ রবিবার তিনি প্রয়াত হলে পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তার দেহ এন আর এস হাসপাতালে দান করা হয়। তারপর, তারপর কোনও শ্রাদ্ধ নয়, শান্তি নয়, নয় কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠান।

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86933